Magic Lanthon

               

আইয়ুব আল আমিন

প্রকাশিত ২৪ মার্চ ২০২৪ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

দর্শক-কথা

হায়রে সিনেমা!

আইয়ুব আল আমিন


১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ। তখন সবে ক্লাস সিক্স-এ পড়ি। বড়ো বোন পড়ে ক্লাস নাইনে। আরো অনেক ভাই-বোন আমাদের। যৌথ পরিবার। হৈ-হুল্লোড় আর আমোদে সময় ভালোই কাটে সবার। সবাই একসঙ্গে স্কুলে যাই-আসি। আর আমি কেবল তার মধ্যে নিয়মিত স্কুল ফাঁকি দিই। কী কারণে যেনো একদিন স্কুলে যাওয়া হয়নি; দুপুরের দিকে মা বললো, কয়েকদিন আগে তোর বড়ো বোনকে যারা দেখতে এসেছিলো, তারা পছন্দ করেছে। আজকেই বিয়ে। মনটা খুব খারাপ হলো। বুবুর সঙ্গে আর স্কুলে যাওয়া হবে না, সবাইকে ফেলে সে চলে যাবে শ্বশুরবাড়ি।

যাহোক, বিকেল গড়িয়ে যায়, সেদিন বুবু আর স্কুল থেকে আসে না। আশেপাশের সব ছাত্র-ছাত্রী বাড়ি চলে এসেছে। বাড়ির সবাই চিন্তায় অস্থির। এদিকে বাবা কার কাছ থেকে যেনো শুনেছে, স্কুল পালিয়ে বুবু গেছে সিনেমা দেখতে। তারপর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলে সেদিন বাবা তাকে খুব মেরেছিলো। অবশ্য সেই রাতেই বুবুর বিয়ে হয়ে যায়। রাতে আয়োজনের এক ফাঁকে আমি গিয়ে বুবুকে চুপি চুপি বললাম, ‘বুবু, শুধু শুধু আজ বিয়ের দিন কেনো সিনেমা দেখতে গেলি? এতগুলো মার খেতে হলো। যাক, মন খারাপ করিস না।’ সান্ত্বনা শুনে উল্টো বুবু আমায় বলেছিলো, ‘ধুত, একটুও মন খারাপ হয়নি আমার। সিনেমা দেখে যতটা মন খারাপ হয়েছে, তার কাছে বাবার এই সামান্য মার কিছুই না। তুই বুঝবি না এসব।’ সেদিন হয়তো সত্যিই আমি ভালো বুঝিনি, তবে বেশ খানিকটা অবাক হয়েছিলাম বুবুর কথায়!

পরের দিন সেই আগ্রহ থেকে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম, বুবু সেদিন সত্যের মৃত্যু নেই সিনেমাটি দেখেছিলো। তখন না বুঝলেও আজ বুঝি, বুবুর সেই আবেগের কথা। সিনেমার প্রতি টানের কথা। আর ভাবি, কই গেলো সেই আবেগ-কান্না আর অবাধ্য অনুভূতিগুলো। পরে আমিও বুবুর মতো সেই আবেগ নিয়ে থানা সদরের সিনেমাহলে প্রতি সপ্তাহে সিনেমা দেখেছি। কোনোটা আবার এক সপ্তাহে দুই-তিন বার! অথচ এখন কেনো জানি সিনেমাহলে গিয়ে টানা দুই ঘণ্টা ধৈর্য ধরে রাখতে পারি না। মাঝে মাঝে ভাবি, এখন কী নেই সিনেমাতে, যা তখন ছিলো? তখন সারাবছর তো ছিলোই, ঈদ-পূজা মানেই নারী-পুরুষ সবার প্রধান আকর্ষণের জায়গা সিনেমাহলে গিয়ে সিনেমা দেখা। আর এখন ওই বয়সের ছেলে-মেয়েরা ওই সময়টাতে কী করে? আগ্রহটা হারালো কোথায়? কেনো?

চুল সাদা হওয়া বিজ্ঞজনেরা এই সিনেমা নিয়ে একেকজন একেক কথা বলেন। তারা এগুলো বলে আসছেন গত দু-দশক ধরে; আর এদিকে সিনেমা তলিয়েই যাচ্ছে। এখন তো একদম তলানিতে। সমস্যাটা কোথায় আমাদের¾যা কেউ ধরতেই পারছে না! একটার পর একটা সিনেমা হচ্ছে¾ওই থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়। দিনকে দিন সিনেমাহলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কারণ কী? উত্তর মেলে না! অথচ এখন যারা সিনেমা বানাচ্ছেন, আপনি যান তাদের কাছে। ওরে বাবা! তার কথা শুনে মনে হবে, জেমস ক্যামেরন, স্টিভেন স্পিলবার্গেরও তার কাছে অনেক কিছু শেখার আছে! হাতি-ঘোড়া মেরে শেষ পর্যন্ত এরা যা বানায়, তা ওই খড়ের ভুতি। অনেকেই বলবে, দু-একটা তো ভালো হচ্ছে। কিন্তু ওই দু-একটা ভালো দিয়ে তো এখন আর কাজ নেই¾আপনি সেটা কাকে বোঝাবেন! নিজের দেশের বাইরে একবার তাকান, বুঝবেন পানি কতো দূর গড়িয়েছে। অনুরাগ কশ্যপরাই ডুব দিয়ে আর ভাসতে পারছেন না।

আবারও বলছি, কোনো একটা বিষয় নিশ্চয়ই আছে, যা এখানে কেউ ধরতে পারছে না। আবারও প্রশ্ন¾কী সেই বিষয়? কেনো বাংলার ছেলে-মেয়েরা আজ বঙ্গীয় চিত্রনায়িকাদের ফেলে অ্যাঞ্জেলিনা, হায়েক, সানিতে বন্দি? তরুণদের এখন বাংলার কোনো অভিনেতা-অভিনেত্রীর প্রতি আগ্রহ নেই। অথচ তারা কিম কারদাশিয়ানের ব্রা’র ব্র্যান্ড পর্যন্ত জানে! এখন শাবানা, ববিতারা ওমরাহ করে এসে সিনেমার বিপক্ষে কথা বলেন। কেনো মুনমুন, ময়ূরীদের ১০-২০ হাজার টাকার জন্য সার্কাস-যাত্রায় নাচতে হয়? কেনো মোরশেদুল, তানভীর, বিপ্লবরা বছরের পর বছর আর সিনেমা তৈরি করেন না? কেনো প্রতিটি বাংলা চলচ্চিত্র দেখলে আজ একই মনে হয়? এর কোনো উত্তর জানা নেই।

আমাদের দেশে আজও কোনো ফিল্ম ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা হয়নি। যারা সিনেমা নিয়ে দেশের বাইরে পড়াশোনা করতে যায়; ফিরে এসে তারা এমন তালগোল পাকায়, যেই তাল শেয়াল-শকুনের কাছেও দুর্বোধ্য মনে হয়। সিনেমার বিজ্ঞাপন এখন একটা মস্ত বড়ো ফ্যাক্টর। কিন্তু এখানে এ নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই; এখনো বিজ্ঞাপন বলতে ওই এক পোস্টার, সামান্য মাইকিং, সংবাদপত্রে দু-একটি প্রতিবেদন। দর্শককে তো জানাতে হবে, এখন একটা সিনেমা আসছে। অথচ কেউ জানার আগেই অনেক সিনেমা শেষ হয়ে যায়। আর বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো তো সারাদিন রাজনৈতিক খবর দেখিয়েই অবসর পায় না। আবার সিনেমা, তাও আবার বাংলা সিনেমা!!!

আর একটা বিষয় হলো সেন্সর বোর্ড। চলচ্চিত্রের সাড়ে সর্বনাশ করার জন্য এইটা ৮০ ভাগ দায়ী, যে যাই বলুক। একজন শিল্পী স্বাধীনভাবে একটা কাজ করার পর সেটার ওপর অশিল্পী যদি কাঁচি চালায়, তবে সেটা শিল্প তো থাকেই না, আরো নীচে নেমে যায়। আর সেন্সর বোর্ডে যারা কাজ করেন তারা কী ফেরেশতা? তারাও তো মানুষই। আর যিনি সিনেমা বানান, তিনিও তো মানুষ। তবে কেনো অহেতুক এই অবরোধ শিল্পের ওপর। আর শ্লীলতা-অশ্লীলতার নামে যা হয় বা যা হয়েছে, তা তো ভণ্ডামির চূড়ান্ত রূপ। এই আপেক্ষিকতার মানদণ্ড বিচার করা কি আর সেন্সর বোর্ড দিয়ে হয়!

আবার এর সঙ্গে কয়েক বছর হলো নতুন করে যোগ হয়েছে ‘আর্ট ফিল্ম’ নামে এক ধোঁকাবাজি। এটা হচ্ছে অজ্ঞতার ওপর বিজ্ঞতার চাদর পরিয়ে সাঁকো পার হওয়ার অভিন্ন কৌশল। একজন বৃদ্ধ ৩০ মিনিট ধরে হেঁটে তার গন্তব্যে পৌঁছা মাত্রই সিনেমা শেষ¾দিস ইজ নাকি আর্ট ফিল্ম!

গোটা বিশ্বে চলচ্চিত্রে প্রযুক্তির উত্তরোত্তর ব্যবহার বেড়েই চলেছে। তাল মিলিয়েছে আমাদের মিনসেরাও। বাট, এখানে বিষয়টা হয়েছে এমন¾অদক্ষ কোনো মানুষের হাতে ঘড়ি-ল্যাপটপ-আইফোন দেওয়ার মতো। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে, ‘শর্টকাট’’ ভাইরাস ঢুকেছে। অন্যদিকে আগে যারা জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রী ছিলেন, এখন তারা প্রবীণ¾এরা কেউই আর আমাদের চলচ্চিত্রের সঙ্গে নেই। কোথায় চলে যায় এরা? কেনো, কোন অভিমানে? এখানে তারা কোন সাপের পাঁচ পা দেখেন, যার জন্য সারাজীবন তিল তিল করে ধারণ করা অভিজ্ঞতা বুকে চেপে প্রস্থান করেন? এর উত্তরও খুঁজি।

নকল পিকাসোও করেছিলেন; বাদ যাননি রবীন্দ্রনাথও। কিন্তু আমাদের নির্মাতারা এমনই প্রতিভাবান, তারা রবীন্দ্রসঙ্গীত নকল করে রবীন্দ্রসঙ্গীতই বানান। অথচ নাম দেন ‘‘দ্য নিউ রবীন্দ্রসঙ্গীত’। সঙ্গীতের কথা যখন এলোই, তখন চলচ্চিত্রে সঙ্গীত ব্যবহার নিয়ে জাস্ট দুটো কথা। আগে চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত গান মানুষের মুখে মুখে ফিরতো। হিন্দিতে মোটামুটি এখনো তাই। তো আমাদের এখানে সমস্যা কী? আল্লাহ মালুম, এটা তিনি ছাড়া কারো বলার সাধ্য নাই। কারণ, এখন যারা চলচ্চিত্রের সঙ্গীত করছেন, গিয়ে দেখেন তাদের বাড়ির পাপোশ পর্যন্ত সঙ্গীতে সঙ্গীতজ্ঞ! দোষ তবে কার?

আপনি ভালো একটা চলচ্চিত্র বানাবেন বলে স্থির করলেন। এর জন্য কিছু সরকারি ও আমলাতান্ত্রিক সহযোগিতা দরকার। যান তাদের কাছে, বুঝবেন বাংলাদেশে ‘কতো ধানে কতো চলচ্চিত্র’! আপনি তারপর সেই ভালো চলচ্চিত্রটা রস বানিয়ে খেলেন। এবং আমরা স্বস্তি পেলাম।

বছর তিনেক আগে এক বন্ধু আমাকে বলেছিলো, পোকা মাকড়ের ঘর বসতি (১৯৯৬) সিনেমাহলে গিয়ে দেখার কী আছে? এটা তো আমাদের গ্রামেই রোজ দেখি। উত্তর থাকলেও, আমি তাকে দিতে পারিনি। কারণ, এমন অতিবাস্তবতা ও অতি-অবাস্তবতা দুই-ই দর্শককে নিরাশ করে। তাহলে পরিত্রাণের উপায় কী? আর একটা বিষয় ইদানীং অতিমাত্রায় চলচ্চিত্রপাড়ায় উপদ্রব আকারে দেখা দিয়েছে। তা হলো সিনেমার বাইরে হিরোইনের সঙ্গে হিরো, পরিচালক ও প্রযোজকের এক ‘মহারহস্যময়’ রসায়ন। একটু ভুল হলো, এটা অবশ্য আজকের বিষয় নয়; শুরু হয়েছে ওই তখন থেকেই। কিন্তু আজকের যে অবস্থা, তাতে কেউ যদি বলে, ‘‘ভূমি তুমি দ্বিধা হও লজ্জা লুকাই’’; তাহলেও বলার কিছু থাকবে না। মাঝে মাঝে মনে হয়, সবই কি কেবল ‘‘যৌবন’’ পর্যন্ত, ‘‘যৌবন’’ শেষ, তারপর আস্তাকুঁড়! অভিনয়ে তাহলে শিল্পী বলে কি কিছুই নেই! অবশ্য এর উত্তরও আমার জানা নেই।

চলচ্চিত্রে আজ কেনো জহির রায়হান নেই, সুভাষ দত্ত নেই, কেনো ঋত্বিক ঘটক নেই, গুরুদত্ত নেই? তাহলে কি এদের প্রয়োজন নেই! প্রয়োজন পড়লে নাকি প্রকৃতি প্রয়োজনীয় বস্তু তৈরি করে দেয়। তাহলে কি এই সময়ে এদের প্রয়োজন নেই? সিনেমা তো শুধু কয়েকটা শট্, ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল আর প্যানেলে বসে ইমেজের পর ইমেজ বসানো নয়। যতো কথাই বলুন, একটা দর্শন না থাকলে সিনেমা কোনোভাবেই সিনেমা হয়ে ওঠে না। হেন বিষয় নেই, যেটা সম্পর্কে ধারণা না থাকলে একজন পরিচালকের চলে। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ¾সব বিষয় জানা ও জানার আগ্রহ থাকতে হয় পরিচালকের। নতুবা চলচ্চিত্র হবে বিকলাঙ্গ। যা এখন হচ্ছে আর কি।

কিছুদিন আগে সিনেমা দেখতে গিয়ে হলের সামনে বিচিত্র এক মানুষের সঙ্গে দেখা। এর আগেও আমি তাকে সিনেমাহলের সামনে দেখেছি, তবে সেভাবে কেনো জানি খেয়াল করা হয়নি। সেদিন তিনি আমার সামনে এসে নিজে নিজেই আনমনে কিছু কথা বলে যাচ্ছিলেন। ‘হায়রে সিনেমা! তোর জন্য আজ আমি বাড়ি ছাড়া, পথের পাগল, আর তুই আমারে পাগল কইরা নিজে নিজেই নাই হইয়া গেলি?’ পাশের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, লোকটা কে? তিনি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, ‘‘আরে পাগল!’’ সিনেমা দেখে ফিরতে ফিরতে ভাবলাম, লোকটা কি সত্যি সত্যিই পাগল? দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে যাই। আর ওই উত্তরও খুঁজে পাই না।

 

লেখক : আইয়ুব আল আমিন, দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় চিত্রশিল্পী হিসেবে কর্মরত। এর বাইরে তিনি নিয়মিত প্রচ্ছদের কাজ করেন।

ayub.fa@gmail.com


বি. দ্র. প্রবন্ধটি ২০১৫ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত ম্যাজিক লণ্ঠনের ৯ম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ হয়।


এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন